“চেপে রাখা ইতিহাস" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ
‘চেপে রাখা ইতিহাস একটি ব্যতিক্রমধর্মী গ্রন্থ। বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টালেই বােঝা যায় এর পেছনে গােলাম আহমাদ মাের্তজা কত সময় ব্যয় করেছেন, কত পরিশ্রম করেছেন। অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির মন্তব্যও রয়েছে বইটিতে। কলকাতা হাইকোর্ট এবং এলাহাবাদ হাইকোর্টের মহামান্য বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত), পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের সম্মানীয় সদস্য জনাব সামসুদ্দিন আহমদ বলেন, “জনাব গােলাম আহমাদ মাের্তজা সাহেবের সুলিখিত ‘চেপে রাখা ইতিহাস গ্রন্থখানি ইতিহাস পাঠের একটি মূল্যবান সংযােজন। ব্রিটিশ আমলে রচিত ভারতের ইতিহাস ইংরাজ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য লিখিত; ঐতিহাসিক অনেক সত্য উপেক্ষিত বা বিকৃত করে দেখানাে হয়েছে। এসবের উর্ধ্বে মূল সূত্র থেকে সত্য প্রতিষ্ঠায় মাের্তজা সাহেবের প্রচেষ্টা সত্যই সাহসিক ও প্রশংসার যােগ্য।” ইংরেজরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ লাগিয়ে রেখে এদেশে তাদের শাসনকাল আরাে দীর্ঘস্থায়ী করতে চেয়েছিল। এজন্যে তারা মুসলমানদের গৌরবের ইতিহাস যেমন বিকৃত করেছে, হিন্দুদের শাস্ত্রগ্রন্থকেও বিকৃত করেছে। সত্য ইতিহাসকে গােপন করে মিথ্যাকে প্রচার করেছে। গােলাম আহমাদ মাের্তজা প্রকৃত সত্যকে খুঁজে বের করেছেন। তুলে এনেছেন সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের চাপা পড়া তথ্য, নবাব সিরাজউদ্দৌলার চেপে রাখা সত্য, অন্ধকূপ হত্যা: ইতিহাসের অলীক অধ্যায়; সিরাজের হত্যাকাহিনী, নবাবদের ইতিহাসে আর একটি সত্য অধ্যায় ইত্যাদি। এসব বিষয়ে এতদিন মানুষ যা জেনেছে তার প্রায় সবই ছিল মিথ্যা আর বিকৃত।
প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকেও চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল । গােলাম আহমাদ মাের্তজা বলেছেন-অনেকের একাধিক নাম থাকে। যেমন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অপর নাম ছিল ‘গদাধর। এখন ইতিহাসে যদি তাকে গদাধর গদাধর বলে প্রকাশ করা হয়, তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত হলে অসাবধানতা এবং ইচ্ছাকৃত হলে অসভ্যতা বলে মনে করা যেতে পারে। তেমনি স্বামী বিবেকানন্দের পূর্বনাম ছিল নরেন্দ্রনাথ । তার আগের নাম ছিল বীরেশ্বর। সেই বীরেশ্বরের সংক্ষিপ্ত বীরে’ থেকে ক্রমে ‘বিলে’ বলেই তাঁকে ডাকা হতাে। এখন তাঁর স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস যদি স্বামী বিলে’ বলে আরম্ভ ও শেষ করা হয় তাহলে তা হবে অতীব দুঃখের। গােলাম আহমাদ মাের্তজা তাঁর চেপে রাখা ইতিহাস' গ্রন্থে মহান মনীষীদের নামের সুন্দরতম ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন।
প্রচলিত ইতিহাসে শেখানাে হয়েছে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতাই ভারতের স্বাধীনতা অস্তমিত হওয়ার মূল কারণ। কিন্তু আধুনিক যুগের বাস্তববাদী ঐতিহাসিক রতন লাহিড়ী মুর্শিদাবাদ জেলার সত্যিকারের ইতিহাসে লিখেছেন, “ঐতিহাসিকরা যার উপর প্রভূত অন্যায় করেছেন তিনি মীরজাফর আলি খা।...ইনি অধিক বয়সে আফিমের নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং দুই নর্তকী বেগমের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকেন। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হিসেবে এর ব্যয় অসম্ভব বেড়ে যায় এবং ক্রমে ইনি জগৎশেঠের ক্রীড়নক হয়ে পড়েন। এমত অবস্থায় তরুণ অনভিজ্ঞ নবাব সিরাজুদ্দৌলা তাঁকে তাঁর বিপক্ষে ষড়যন্ত্রকারী বলে আটক করেন। এতে ইনি সম্পূর্ণ সিরাজের বিরােধী পক্ষে চলে যান এবং পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে পরাজিত করতে ইংরাজকে সবিশেষ সাহায্য করেন।” এই বেঈমানীর পুরস্কার স্বরূপ মীরজাফর শেষ বয়সে কুষ্ঠরােগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। জগৎশেঠ, দেবীসিংহ, নন্দকুমার, কান্তবাবু, গঙ্গাগােবিন্দ সিংহ এরা সবাই ছিল বেঈমান। ইংরেজদের সঙ্গে মিলে এদের ষড়যন্ত্রেই ভারতের স্বাধীনতা-সূর্য অস্তমিত হয়েছে পলাশীর প্রান্তরে। যে সমস্ত বিশ্বাসঘাতক অর্থের বিনিময়ে | নিজের দেশকে সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে তুলে দিয়েছিল-তরুণ নবাবের বিশ্বাসের সুযােগ নিয়ে তাঁর সর্বনাশ করেছিল, তাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শয়তান নন্দকুমার। তিনি হুগলীর ফৌজদার থাকার সময় ঘুষ খেয়ে ইংরেজদের শুধু ছেড়ে দেননি উপরন্তু বিনা বাধায় কলকাতা পুনর্দখল করতে দেন। সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়ক ছিলেন এই শয়তানের অনুচর। শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের হাতেই এই শয়তানের ফাঁসি হয়। এরকম বহু চাপা পড়া তথ্য উঠে আসে এই গ্রন্থের পাতায়।
গােলাম আহমাদ মাের্তজার ‘চেপে রাখা ইতিহাস' একটি আকর গ্রন্থ। ইতিহাসের শিক্ষার্থীদের জন্যে এটি একটি মূল্যবান দলিল। অধ্যাপক সত্যনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “চেপে রাখা ইতিহাস’ পুস্তকটি প্রতিটি শিক্ষিত, বিশেষ করে ইতিহাসের ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকের পড়া উচিত।”
ডাউনলোড লিঙ্ক
👇👇👇👇👇👇👇